Short Story : টিচার্স ডে
ক্লাস জুড়ে যেন তাণ্ডব চলছে। কেউ চেঁচাচ্ছে, কেউ হাসছে হ্যা হ্যা করে, কেউ বা হেঁড়ে গলায় গান গাইছে। আবার দু একজন রবি ঠাকুরের কবিতা বিড় বিড় করছে। সামনে টিচার্স ডে আসছে, তাই সমস্থ ক্লাসটা একটা মেছো বাজারের রূপ নিয়েছে। তারি মাঝে ক্লাস মনিটরের সাবধান বাণী ভেসে আসে – এই তোরা চুপ কর, একটু পরেই কে.পি র ক্লাস। হঠাৎ যেন নিস্তব্ধতা নেমে আসে সমস্ত ক্লাসরুমে। কে.পি মানে – করবী পাল। ওরে বাবা আজ তো আবার অঙ্কের টেস্ট নিতে পারে – কি যে হবে। সারা ক্লাস জুড়ে ফিস ফিস। বিদ্যুৎ তার পাশের বন্ধুকে বলছে – এই শালা এক ম্যাডাম, না আছে রস কষ – না আছে থোবড়া। ভাল্লাগে না – এদিকে যে ক্লাস কাটব তারও উপায় নেই। সব্বার মুখ চেনে। স্বগতোক্তির মাঝখানে ক্লাসে উপস্থিত করবী পাল। গম্ভীর মুখে বসন্তের দাগ। তার উপর মাসিমা মার্কা চশমা। বয়স পঁয়তাল্লিশ দেখায় বাহান্ন। উৎকট গাম্ভীর্যে মুখের মধ্যে কোথাও যেন কোন প্রসন্নতা নেই। ক্লাসে এসেই অঙ্ক করাতে শুরু করে দিলেন। পঁয়তাল্লিশ মিনিট ছাত্র ছাত্রী দের বিদ্ধস্ত করে দিয়ে টিচার্স রুমে গিয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে মুখটা রুমাল দিয়ে মুছলেন। করবী চেয়ারে বসার পরেই টিচার্স রুমের চারপাশের কথাবার্তাও যেন নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেল। তার নিরব উপস্থিতি অনেকেরই বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। ব্যাজার মুখ করে সবাই একটু চুপচাপ হয়ে যায়। করবী জোরে বলে ওঠেন – রাঘুনাথ, চা দাও।
বাড়ি ফিরে সন্ধেবেলায় স্নান সেরে নিজের ছোট ফ্ল্যাটের ইজি চেয়ারে বসে আনমনে চোখ বুজে সারাদিনের একটা ছবি ভাবেন করবী। সহজেই বুঝতে পারেন ছাত্রছাত্রী বা সহকর্মী কারোর কাছেই তিনি প্রিয় নন। তার গাম্ভীর্য, তার ব্যাক্তিত্ব সবার সঙ্গে একটা আড়াল এনে দিয়েছে। আসলে অল্প বয়সে পিতৃহীন হয়েছিলেন। রুঢ় বাস্তব যখন চোখের সামনে এল, তিনি বুঝলেন যে একমাত্র শিক্ষাই তাকে এগিয়ে নেবে। পড়াশুনায় বিশেষ করে অঙ্কে ভাল ছিলেন। তাই সব পরিশ্রমের সঞ্চয় ওই নীরস বিষয়টিতে ছড়িয়ে দিলেন। ফলও পেলেন। ভাল রেজাল্ট। একমাত্র সন্তান ছিলেন, তাই মায়ের দায়িত্ব পুরোটাই তার। শেষে মাও চলে গেলেন। রুপের অভাব তো তার ছিলই, তবে স্বভাবে হয়তো আর একটু মাধুর্য আনা যেত। কিন্তু তিনি নিজেও জানেন না কেন যেন এক কাঠিন্যের বর্ম তাকে ঘিরে রেখেছে। হয়েতো পরিবেশ, পরিস্থিতি তাকে এই প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।
পরের দিন ক্লাস নেই। টিচার্স ডে - সব শিক্ষক রাই মিলিত হবেন হল-এ। ছাত্রছাত্রীরা একটা সুন্দর অনুষ্ঠান করবে। এছাড়া করবী বোঝেন যে আলাদা করেও বহু ছাত্রছাত্রী তার শিক্ষকদের কিছু না কিছু উপহার দেয়। হঠাৎ করবীর মনে হল – হতে পারেন তিনি রুক্ষ; হতে পারেন তিনি গম্ভীর – কিন্তু এও তো সত্যি যে পড়াশোনাতে তিনি নিরলসা, তাহলে কি এমন কেউ নেই যে ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে তিনিই প্রিয়। হয়তো সে কাল তাকে কোন উপহার দেবে।
সারারাত ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হল করবীর। এযেন এক অগ্নিপরীক্ষা। একবার নিজের অস্তিত্বের সঠিক মূল্যায়ন করার একটা দুরন্ত ইছে তাঁকে অস্থির করে তুলল। কেউ কি নেই যে তার কাঠিন্যের অন্তরালে পরিশ্রমী শিক্ষক সত্তাটাকে চিনে নেবে? যার কাছে তিনিও প্রিয় শিক্ষিকা হয়ে উঠবেন? অনেকের মত তিনিও তার কাছ থেকে কোন উপহার পাবেন?
পরের দিন স্কুল যাবার পথে একগুচ্ছ গোলাপ তিনি কিনলেন। ভাবলেন – চেয়ারের ওই প্রান্তে বসা এতগুলো মুখের মধ্যে একটি মুখও যদি তাঁকে সেই সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার স্বীকৃতি দেয় তবে তিনিও তার হাতে গোলাপের এই তোড়া তুলে দেবেন।
শিক্ষক রুমে গিয়ে দেখেন শিক্ষকরাও আজ একটু অন্য মেজাজে। সবাই বেশ প্রফুল্ল, ঈষৎ সাজগোজ ও করেছেন। তারই মাঝে মাঝে স্যার বা ম্যাডাম একটু বাইরে আসবেন প্লীজ – বলে অনেক ছাত্রছাত্রীই অনেক শিক্ষক শিক্ষিকাকে ডেকে নিচ্ছে। কিছু পরে তারা অপ্রস্তুত মুখে উপহার নিয়ে ঘরে ঢুকছেন। কি যে করে না এরা, যত সব ছেলেমানষী। এই সব কথার নেপথ্যেও থাকছে পরিতৃপ্তির সুর।
তারপর যথারীতি হলে অনুষ্ঠান শুরু হল। বহু ছাত্রছাত্রীর মিলিত চেষ্টায় একটা সুন্দর অনুষ্ঠান সবাই দেখলেন। করবী শুধু ভাবছেন এই অগণিত ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে কেউ কি নেই যে এসে বলবে – ম্যাডাম আপনি আমার বিশেষ প্রিয়।
এই ভাবনার ঊর্ণনাভের মধ্যে কখন যেন অনুষ্ঠানটি শেষ হয়ে যায়। এবার বাড়ি ফেরার পালা।
ফাঁকা টীচার্স রুমে বসে হঠাৎ করবীর দুটি চোখ জলে ভরে গেল। কেউ কি তাকে বুঝল না? আপাত কাঠিন্যের অন্তরালে তাঁর একনিষ্ঠ অধ্যাবসায়ী শিক্ষক সত্ত্বাকে কেউ কি চিনল না? তাহলে কিসের টিচার্স ডে পালন?
নিজেকে সংযত করলেন করবী, তারপরে একবার ফাঁকা হলে গিয়ে দাঁড়ালেন। সামনে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের আবক্ষ ছবি আর চারিদিকে ছড়িয়ে আছে অনুষ্ঠান শেষের রঙীন শিকল, ছেঁড়া ফুলের পাপড়ি, চন্দনের সৌরভ। ছবিটির সামনে একটু সময়ের জন্য তিনি দাঁড়ালেন। তারপর ওই হলুদ গোলাপের গুচ্ছটি ছবির কাছে রেখে চোখের অশ্রুবিন্দুটি মুছে নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন মধ্য চল্লিশের শিক্ষিকা করবী পাল।
VERY NICE, HEART TOUCHING AND I AM SURE THERE ARE MANY SUCH TEACHERS WHO DO THEIR JOBS SILENTLY WITH UTMOST CARE WITHOUT BEING VOCAL.
আমরা সহজেই হালকা হাসি, তুচ্ছ খুশিতে ভুলি । সেটা স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের যে আরও বেশি থাকবে, সে তো জানাই । করবী দিদি যদি নিজে থেকে মনের জানলা টা একটুও খুলতেন তবে এসব তরলমতি ছাত্র ছাত্রীরা তাঁকে দুঃখ দেবার বদলে অনেক আনন্দ দিত। গুরু শিষ্যের মানসিক যোগটুকু না থাকলে বিদ্যাদান অসম্পূর্ণ থেকে যায় ।
এই গল্পটা আমার হৃদয় স্পর্শ করে গেছে। একবারের জন্য ,আমার স্কুল জীবনের স্মৃতি উস্কে দিয়েছে। মনে হচ্ছে যে, আমি ও বোধহয় অজান্তে কোন শিক্ষকে দুঃখ দিয়ে ফেলি নি ত ?
What a nice piece… reminds me of our Taruna Miss (PT teacher).. Always silent with a grave face… We always try to avoid her class. But she was the one who shaded her tear when our batch leave the school after 10th exam..
Today I will like to take the gratitude to say… ” WE LOVE YOU… TARUNA MISS”….
Thankyou Poulami for the comments, the comments have been forwarded to the author
A fantastic heart warming story which takes us back to school days. Beautifully written in simple words. Kudos to the author.